Friday 22 May 2015

সহিহ হাদিসের আলোকে আমাদের সলাত ও বিশ্লেষণ পার্ট ১



সহিহ হাদিসের আলোকে আমাদের সলাত ও বিশ্লেষণ পার্ট ১

সহিহ হাদিস ভিত্তিক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশিত সালাতের পদ্ধতির বর্ণনা
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর যিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিক দাতা ও জ্ঞানদাতা| শান্তি বর্ষিত হোক সর্ব শেষ রাসুল, সর্ব শ্রেষ্ঠ রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ও তার পরিবার পরিজনের উপর|
মৃত্যুর পর মানুষের দৈহিক আমল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়| শুধু তিনটি রাস্তা খোলা থাকে সওয়াব পৌছানোর জন্য| আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা:) বলেছেন, “যখন কোন মানুষ মারা যায় তখন তার সমস্ত আমলের সওয়াব বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব বন্ধ হয় না। তাহচ্ছেঃ (১) তার সদকায়ে জারিয়া (২) তার প্রবর্তিত এমন কোন জ্ঞান-বিজ্ঞান যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়, (৩) তার রেখে যাওয়া এমন সন্তান যে তার জন্য দো’আ করে (মুসলিম)।
১. সদকায়ে জারিয়া অর্থাত এমন দান যার ক্রিয়া চলমান থাকে| যেমন মসজিদ নির্মান বা নির্মানে সাহায্য করা, এতিমখানা নির্মান বা নির্মানে সাহায্য করা, বা এমন কোনো কাজ করা যার থেকে মানুষ উপকার পেতেই থাকে যেমন বৃক্ষ রোপন, পানির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি|
২. এমন জ্ঞান বা বিদ্যা রেখে যাওয়া যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়| যেমন কাওকে কুরআন শিক্ষা দেওয়া, হাদিস শিক্ষা দেওয়া, কুরআন বিতরণ করে যাওয়া, ইসলামিক কিতাব রেখে যাওয়া ইত্যাদি|
৩. নেক সন্তানের দুআ| এখানে শুধু সন্তানদুআ নয় বরং ‘নেক সন্তানের’ দুআ বলা হয়েছে|
মৃত্যুর পরেও যেন আমাদের সওয়াব চলমান থাকে এবং এই একটি কাজের বিনিময়কে বৃদ্ধি করে মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে, আমাকের পিতা-মাতাকে, আমাদের ভাই-বোনদের, দাদা-দাদী, নানা- নানিকে ক্ষমা করেন এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত বর্ধিত করেন এই আশায় এই লেখাটি লেখার চেষ্টা করছি| 
মহান আল্লাহই একমাত্র নির্ভুল আর আমরা অবশ্যই ভুলের করি| এই লেখায় কোনো ভুল ধরা পড়লে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন| যে কেউ ভুল পেলে অবশ্যই আমাদের জানিয়ে দিবেন সংশোধন করা হবেই ইনশাআল্লাহ|

সম্মানিত পাঠক গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করুন!
মহান আল্লাহ বলেন, ‘এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে| সুরা বাকারাহ ২-৩|

অর্থাত আল কুরআন হচ্ছে সন্দেহমুক্ত কিতাব এবং আমাদের জন্য পথ প্রদর্শক| এই সন্দেহমুক্ত ও আমাদের জন্য পথ প্রদর্শক কুরআনের আরো কিছু আয়াত গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করি আসুন|
মহান আল্লাহ বলেন,
”যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ), তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।” সুরা নিসা ৮০ |

মহান আল্লাহ রাসুল (সাঃ) এর অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে আরো বলেন,
আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই; যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্ট তায় পতিত হয়। সুরা আল আহযাব ৩৬
এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর আদেশ অমান্য করে সে পথভ্রষ্টতায় পতিত হলো| আমরা যদি রাসুল (সাঃ) এর আদেশ নির্দেশকে হেলাফেলা অবজ্ঞা করি বা উপেক্ষা করি তবে আমরা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হব, সঠিক পথ থেকে ভুল পথে চলে যাব |

মহান আল্লাহ আরো স্পষ্ট করে আমাদের বলেন, ”রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” সুরা হাশর ৭

কুরআনের উল্লেখিত আয়াত গুলোর পর আমরা এখন একটি হাদিস লক্ষ্য করি মনোযোগের সাথে,
”আমি তোমাদের মাঝে দুটি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা এ দুটি আক্রে থাকবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না| বস্তু দুটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত|” মুয়াত্তা মালেক হাদিস ৩৩৩৮ আল-জামে অধ্যায়; হাকেম হাদিস ৩১৯ ইলম অধ্যায়; মিশকাত ১৮৬ ইলাম অধ্যায়; সনদ হাসান|
হাদিসটি মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করতে আমরা দেখব এতে বলা হয়েছে ‘যতক্ষণ’ কুরআন ও সুন্নাহ আমরা আকড়ে থাকব ‘ততক্ষণ’ পথভ্রষ্ট হব না| অর্থাত ‘যতক্ষণ এবং ততক্ষণ”|
যখনই আমরা কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে মানুষের মতামতকে প্রাধান্য দিব তখনই পথভ্রষ্ট হয়ে যাব| অতএব আমাদের অনুসরণ করতেই হবে রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাত কে|

অতঃপর এই হাদিসটি, “যে ব্যক্তি শরীয়তে নতুন কিছু আবিষ্কার করল যা, শরীয়তের অংশ নয় তা বর্জনীয়’’। (মুসলিম)

”শেষ যুগে আমার উম্মতের কিছু মানুষ তোমাদেরকে এমন সব হাদিস বলবে যা তোমরা বা তোমাদের পিতা-পিতামহগণ কখনো শুনে নি| খবরদার! তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে তাদের থেকে দুরে থাকবে|” (সহিহ মুসলিম)

অতএব এটা স্পষ্ট হলো যে হাদিস সহিহ অর্থাত বিশুদ্ধ হাদিস যেমন রয়েছে তেমনি জাল বানোয়াট মানুষের তৈরী হাদিসও রয়েছে| আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে শুধুমাত্র সহিহ বা বিশুদ্ধ হাদিস| 

মাঝহাব: মাঝহাব মানে হচ্ছে মতামত| প্রচলিত চার মাঝহাব হচ্ছে প্রসিদ্ধ চারজন ইমামের মতামত| প্রত্যেক ইমাম বলেছেন ‘সহিহ হাদীসই আমার মাঝহাব|’ তারা বলেছেন ‘সহিহ’ হাদিস অর্থাত বিশুদ্ধ হাদিস হলেই তা-ই তাদের মতামত| তারা এই কথা এই জন্যই বলেছেন কারণ রাসুল (সাঃ) এর কথার উপর কারো কথা চলে না| এবং তারা এই জন্যই ‘সহিহ হাদিসের’ কথা বলেছেন কারণ সমাজে রাসুল (সাঃ) এর নামে মিথ্যা হাদিসও রয়েছে| কেও যেন রাসুল (সাঃ) নাম ব্যবহার করে মনগড়া কথা ঢুকিয়ে দিতে না পারে সেই জন্যই ইমামগণ বলে গিয়েছেন, ‘সহিহ হাদীসই তাদের মতামত|’

সহিহ হাদীসই যদি তাদের সবার মতামত হয়ে থাকে তবে কি আর কোনো বিভেধ রয়েছে? অবশ্যই না| তাহলে আমরা দেখছি হানাফি মাঝহাব = সহিহ হাদিস, মালেকি মাঝহাব = সহিহ হাদিস, শাফেই মাঝহাব = সহিহ হাদিস, হাম্বলী মাঝহাব = সহিহ হাদিস| অর্থাত হানাফি = মালেকি = শাফেই = হাম্বলী = সহিহ হাদিস| সবারই একই কথা সহিহ হাদিস| অর্থাত এই সকল মাঝহাবের মূলে কোনই পার্থক্য নেই| আমরা প্রচলিত সমাজে যে সকল পার্থক্য দেখি তা হচ্ছে মানুষের গোয়ার্তুমির জন্য| এগুলো মানুষের সৃষ্ট পার্থক্য|

হাদিস সহিহ (বিশুদ্ধ) বা হাসান (ভালো) হলেই কেবল তা গ্রহণযোগ্য| জইফ (দুর্বল) হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়| তাছাড়া বিশুদ্ধ হাদিস থাকতে কেন দুর্বল হাদিসের উপর আমল করতে হবে? বিশুদ্ধ বিষয়ের উপরে কি দুর্বল বিষয় প্রাধান্য দেয় যায়?

আমাদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে রাসুল (সাঃ) এর কথাকে| অন্য কারো মতামত যদি রাসুল (সাঃ) এর মতামতের অনুকূলে না যায় তবে সেই মতামত মানা যাবে না| কারণ স্বয়ং আল্লাহ বলছেন রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” সুরা হাশর ৭
এবং স্বয়ং রাসুল (সাঃ) আমাদের মাত্র দুটো বিষয়কে আকড়ে থাকতে বলেছেন ১. কুরআন ২. হাদিস বা সুন্নাহ| অতএব কুরআন ও সুন্নাহের বিপরীত কোনো মতামত আমরা মানতে পারবনা|

এখানে একটি কথা স্পষ্ট করেই বলতে হয় তা হলো রাসুল (সাঃ) এর সহিহ হাদিস এর বিপরীতে কোনো ইমামের মতামতের কোনো মূল্য নেই| আর প্রত্যেক ইমাম নিজেদের রক্ষা করে গিয়েছেন| তারা বলে গিয়েছেন , ‘সহিহ হাদীসই তাদের মতামত|’ অতএব ইমামের নাম করে মাঝহাবের নাম করে বর্তমানে যারা দ্বীনকে বিভক্ত করেছে তাদের থেকে সাবধানতা অবলম্বন না করলে ‘পথভ্রষ্টতায়’ পড়তে হবে|

“যে ব্যক্তি শরীয়তে নতুন কিছু আবিষ্কার করল যা, শরীয়তের অংশ নয় তা বর্জনীয়’’। (মুসলিম)

নিয়ত:- নিয়ত আরবী শব্দ। এর বাংলা অর্থঃ ইচ্ছা করা, মনস্ত করা, এরাদা করা, সংকল্প করা। ফতহুল বারী, ১/১৭) “আমল সমূহ নিয়তের (ইচ্ছার) উপর নির্ভরশীল, আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি পার্থিব জীবনে সুখ-শান্তি লাভের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে সে তাই পাবে। কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করবে সে তাই পাবে“। (বুখারী, প্রথম হাদীস)

প্রিয় পাঠক! মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত তথা ‘নাওয়াইতুআন…’ নিয়তের কোনো দলিল প্রমান নাই| যে কোনো কাজে যেমন অযু, সালাত, সিয়াম, যাকাত, দান-খয়রাত কোন ক্ষেত্রেই প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরকম শব্দ পড়ে নিয়ত করেন নি। কোন সাহাবী বা তাবেয়ী আর না চার ইমামদের কেউ এরকম নিয়ত পড়তেন। তাই যে আমল নবীজী কিংবা সালাফে সালেহীন দ্বারা প্রমাণিত নয় সে আমল অবশ্যই একটি শরীয়তে আবিষ্কৃত নতুন আমল যা, বিদআত। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “যে ব্যক্তি শরীয়তে নতুন কিছু আবিষ্কার করল যা, শরীয়তের অংশ নয় তা বর্জনীয়’’। (মুসলিম)

নিয়ত করতে হয়, পড়তে হয় না| ছোট্ট একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, নিয়ত মনের ব্যাপার| তিন বন্ধু সালাতে দাড়িয়েছে| এদের মধ্যে এক বন্ধু বাকি দুই বন্ধুকে দেখানোর জন্য সালাতে দাড়িয়েছে| মুখে সে যতই ‘নাওয়াইতুআন…’ বলুক তার নিয়ত কিন্তু প্রকৃত সালাত তথা আল্লাহর ইবাদতের জন্য নয় বরং বন্ধুদের দেখানো উদ্দেশ্য| অর্থাত নিয়ত হচ্ছে অন্তরে স্থির করার বিষয়| 

তাহারাত বা পবিত্রতা :
তাহারাত বা পবিত্রতা দুই ধরনের| ১. ফরজ গোসল ২. অজু | গোসল ফরজ হলে শুধু অজু দিয়ে কোনো ইবাদত হবে না| ফরজ গোসল করতে হবে| গোসলের সাথে অজুর নিয়ত না করলে বা গোসলের পূর্বে অজু না করলে শুধু গোসল দিয়ে অজুর কাজ হবে না| কারণ? প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভর করে| তাই অজুর নিয়ত ব্যতীত গোসলের নিয়তে অজু কিভাবে হবে?
মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা ছালাতের জন্য প্রস্ত্তত হও, তখন তোমাদের মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় কনুই সমেত ধৌত কর এবং তোমাদের মাথা মাসাহ কর ও পদযুগল টাখনু সমেত ধৌত কর…..’ মায়েদাহ ৬ |
আয়াত থেকে দেখা যাচ্ছে অজুর ফরজ চারটি: ১. মুখমন্ডল ধোয়া ২. কনুই পর্যন্ত দুই হাত ধোয়া ৩. মাথা মাসেহ করা ৪. দুই পা টাখনু পর্যন্ত ধৈত করা|

এই চারটি ফরজ কাজ বাদে অযুতে বাকি কাজ গুলো সুন্নত| এই সুন্নতগুলো ছেড়ে দিলে অজু হবে না কারণ আল্লাহ বলেন ”রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” সুরা হাশর ৭ | ”যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। সুরা নিসা ৮০ |
ওযূর তরীকা :
(১) প্রথমে মনে মনে ওযূর নিয়ত করতে হবে। নিয়ত হচ্ছে অন্তরের বিষয়, মুখে উচ্চারণের বিষয় নয়| অন্তরে মনে মনে স্ত্রীর করা যে আমি অজু করছি ব্যাস| (মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ= যে হাদিস বুখারী ও মুসলিম দুটিতেই রয়েছে সে সকল হাদিসকে মুত্তাফাক আলায়হে বলা হয়, মিশকাত হা/১)

(২) তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলবে। (আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০২, ‘ওযূর সুন্নাত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৪; আবুদাঊদ হা/১০১-০২; সুবুলুস সালাম হা/৪৬৩; নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী একে ‘ফরয’ গণ্য করেছেন- আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ ১/১১৭); শায়খ সালেহ আল উসায়মিন তার আরকানুল ইসলাম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন বাথরুমে অজু করলে মনে মনে বিসমিল্লাহ বলতে হবে; বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব নয় এটা সুন্নত| 

(৩) ডান হাতে পানি নিয়ে [আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪০১; নায়লুল আওত্বার ১/২০৬ ‘কুলি করার পূর্বে দু’হাত ধোয়া’ অনুচ্ছেদ।]
দুই হাত কব্জি সহ ধৌত করতে হবে [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, আহমাদ, নাসাঈ, নায়লুল আওত্বার ১/২০৬ ও ২১০।]
এবং আঙ্গুল সমূহ খিলাল করতে হবে ।[ নাসাঈ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০৫ ‘ওযূর সুন্নাত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৪।]

(৪) ডান হাতে পানি নিয়ে ভালভাবে কুলি করতে হবে ও প্রয়োজনে নতুন পানি নিয়ে নাকে দিয়ে বাম হাতে ভালভাবে নাক ঝাড়তে হবে। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪; দারেমী, মিশকাত হা/৪১১; মিরক্বাত ২/১৪ পৃঃ; মাজমূ‘ ফাতাওয়া উছায়মীন (রিয়াদ: ১ম সংস্করণ ১৪১৯/১৯৯৯) ১২/২৫৭ পৃঃ ।]

(৫) কপালের গোড়া থেকে দুই কানের লতী হয়ে থুৎনীর নীচ পর্যন্ত পুরা মুখমন্ডল ধৌত করতে হবে [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, নায়লুল আওত্বার ১/২১০।]

ও দাড়ি খিলাল করবে।[ তিরমিযী হা/২৯-৩১, অনুচ্ছেদ-২৩; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০, নায়লুল আওত্বার ১/২২৪]

এজন্য এক অঞ্জলি পানি নিয়ে থুৎনীর নীচে দিবে।[আবুদাঊদ হা/১৪৫, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-১, ‘দাড়ি খিলাল করা’ অনুচ্ছেদ-৫৬।]

(৬) প্রথমে ডান ও পরে বাম হাত কনুই সহ ধৌত করতে হবে | [বুখারী হা/১৪০, নায়লুল আওত্বার ১/২২৩।]

(৭) হাতে নতুন পানি নিয়ে, আপনি ফেলে [তিরমিযী, মিশকাত হা/৪১৫ ‘ওযূর সুন্নাত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৪।]
দু’হাতের ভিজা আংগুলগুলি মাথার সম্মুখ হ’তে পিছনে ও পিছন হ’তে সম্মুখে বুলিয়ে একবার পুরা মাথা মাসাহ করবে। [মুওয়াত্তা, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৩-৯৪] এখানে উল্লেখ্য যে সম্পূর্ণ মাথা আগা থেকে শেষ পর্যন্ত মাসেহ করতে হবে| কপালের চুল থেকে মাথায় হাত ঘষা দিয়ে ঘাড়ের আগপর্যন্ত যেখান পর্যন্ত চুল আছে সেখান পর্যন্ত নিয়ে আবার পুনরায় ঘষা অবস্থায় হাত ফিরিয়ে আনতে হবে কপালের দিকে|
সতর্কতা: হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাড় মাসেহ করা বিদাত| কারণ রাসুল (সাঃ) থেকে ঘাড় মাসেহ করার কোনই বিশুদ্ধ প্রমান নাই| 

একই সাথে ভিজা শাহাদাত আংগুল দ্বারা কানের ভিতর অংশে ও বুড়ো আংগুল দ্বারা পিছন অংশে মাসাহ করবে।[নাসাঈ হা/১০২, ইবনু মাজাহ, নায়ল ১/২৪২-৪৩ ; আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৪১৪।]

পাগড়ীবিহীন অবস্থায় মাথার কিছু অংশ বা এক চতুর্থাংশ মাথা মাসাহ করার কোন দলীল নেই। বরং কেবল পূর্ণ মাথা অথবা মাথার সামনের কিছু অংশ সহ পাগড়ীর উপর মাসাহ অথবা কেবল পাগড়ীর উপর মাসাহ প্রমাণিত। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মির‘আত হা/৩৯৬, ৪০১ -এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য ২/৯২, ১০৪]

(৮) ডান ও বাম পায়ের টাখনু সমেত ভালভাবে ধৈত করতে হবে| [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪; মুসলিম, মিশকাত হা/৩৯৮]

ও বাম হাতের আংগুল দ্বারা পায়ের আংগুল সমূহ খিলাল করবে। [আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪০৬-০৭।] শীতকালে অঙ্গ শুকনা থেকে যাওয়ার আশংকা থাকে তাই ভালোভাবে ঘষতে হবে|

(৯) ওযূ শেষে বাম হাতে কিছু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দিবে [আবুদাঊদ হা/৩২-৩৩, ১৬৮; আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৬১, ৩৬৬ ‘পেশাব-পায়খানার আদব’ অনুচ্ছেদ-২; ছহীহাহ হা/৮৪১।] যাদের শুধু সন্দেহ হয় যে প্রস্রাব বুঝি বের হচ্ছে বের হচ্ছে তারা এই কাজ টি করবে| কারণ এটি শয়তানের ওয়াসয়াসা| 
(১০) ওযূর অঙ্গগুলি এক, দুই বা তিনবার করে ধোয়া যাবে। [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৯৫-৯৭, ‘ওযূর সুন্নাত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৪।]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার করেই বেশী ধুতেন। [মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/২৮৭, ৩৯৭; নায়ল ১/২১৪, ২৫৮]

তিনের অধিকবার বাড়াবাড়ি।[নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪১৭]

অজু শেষে দুআ :

ওমর ফারূক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত উক্ত হাদীছে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে ওযূ করবে ও কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। যেটা দিয়ে ইচ্ছা সে প্রবেশ করবে’। [মুসলিম, তিরমিযী, মিশকাত হা/২৮৯ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-৩।]
উচ্চারণ : আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহূ লা-শারীকা লাহূ, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহূ ওয়া রাসূলুহু। আল্লা-হুম্মাজ্‘আল্নী মিনাত্ তাউয়াবীনা ওয়াজ্‘আল্নী মিনাল মুতাত্বাহ্হিরীন।

অর্থ : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক ও শরীক বিহীন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’ (মুসলিম), হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন!! (তিরমিযী)।
উল্লেখ্য যে, এই দো‘আ পাঠের সময় আসমানের দিকে তাকানোর হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ।[আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ১/১৩৫ পৃঃ, হা/৯৬-এর ব্যাখ্যা।]

সহিহ হাদিস ভিত্তিক রাসুল (সাঃ) এর সালাত আদায়ের পদ্ধতি সংক্ষেপে বর্ণনা করার চেষ্টা করছি ইনশাআল্লাহ:

রাসুল (সাঃ) বলেন, “তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর, যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখ”। (বুখারী ১/৮৮,মিশকাত হা/৬৩১,৬৬ পৃঃ)
রাসুল (সাঃ) এর সাথে মসজিদে জামায়াতে মহিলারাও সালাত আদায় করতেন(বুখারী); অতএব উপরোক্ত কথাটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য| রাসুল (সাঃ) পুরুষ ও স্ত্রী লোকের জন্য আলাদা কোনো সালাতের পদ্ধতি দেন নি| নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই একই পদ্ধতি| আমাদের সমাজে যে পার্থক্য তৈরী করা আছে তা নিতান্তই কিছু জাল ও বানোয়াট হাদিসের প্রেক্ষিতে মনগড়া তৈরী|
আল্লাহ বলেন ”রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” সুরা হাশর ৭ | ”যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। সুরা নিসা ৮০ |
অর্থাত পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সালাতের পদ্ধতিগত কোনো পার্থক্য নেই|

নিয়ত: নিয়ত করা ফরজ| বুখারী ১ম হাদিস| নিয়ত অন্তরে করতে হয়| উচ্চারণ করে ‘নাওয়াইতুআন….’ নিয়ত পড়ার কোনো দলিল প্রমান নাই| উচ্চারণ করে হোক আরবিতে বা বাংলায় নিয়ত পাঠ করা বিদআত |
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্‌র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসায়ী, হাদীস নং ১৫৬০, হাদীসের শব্দ চয়ন নাসায়ী থেকে। আবু দাউদ, তিরমিজি ]

অতএব প্রত্যেক বিদআত = বিদাতে হাসানাহ+ বিদাতে সায়িয়াহ = পথভ্রষ্টতা = পরিনাম জাহান্নাম| সমাজে বিদাতে হাসানাহ নামে যা চালু আছে মূলত তা হচ্ছে পথভ্রষ্টতা| কেননা রাসুল (সাঃ) ‘প্রত্যেক বিদআত” বলে উল্লেখ করেছেন| কোনো বিদাতকে আলাদা করে ভালো বলেন নি| সুতরাং আমাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে|

সালাত:
মহান আল্লাহ বলেন, এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর। [সূরা তা-হা ১৪]
সালাতের জন্য দাড়াতে হবে, দাড়াতে অক্ষম হলে বসে, বসতে অক্ষম হলে শুয়ে ইশারায় সালাত আদায় করতে হবে| আল্লাহ বলেন,
আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে … [সূরা আলে -ইমরান ১৯০- ১৯১]

সালাত যেভাবে শুরু করতে হবে:
আমাদের সমাজে সালাত শুরুর পূর্বে জায়নামাজের দুআ পড়া হয় যার কোনই ভিত্তি নাই বরং হাদিসের বিপরীত উল্টো কাজ এবং বিদআত| জায়নামাজের দুআ বলে কোনো দুআ নেই|
পাঠক! আবার স্মরণ নিন, আল্লাহ বলেন ”রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” সুরা হাশর ৭ | ”যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। সুরা নিসা ৮০ |
রাসুল (সাঃ) বলেন, “তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর, যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখ”। (বুখারী ১/৮৮,মিশকাত হা/৬৩১,৬৬ পৃঃ)|

১. দাড়ানো: মহান আল্লাহ বলেন, সমস্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও। সুরা বাকারাহ ১৩৮|
সোজা হয়ে কেবলামুখী হয় দাড়াতে হবে| আমাদের দেশে পশ্চিম দিক বলে অনেকে| এটা ঠিক নয়| পশ্চিম থেকেও একটু ডান দিকে হেলে কেবলার দিক|
রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘তুমি যখন সালাতের জন্য দাড়াবে তখন কেবলামুখী হয়ে তাকবির বলবে|’ বুখারী ও মুসলিম |
দুই পায়ের মাঝখানে কতটুকু ফাকা রাখতে হবে তার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই| স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ দাড়ালে দুই পায়ে যতটুকু ফাকা থাকে ততটুকুই| কাতার সোজা করতে গিয়ে প্রয়োজনের নিরিখে যতটুকু ফাকা করতে হয়| গুনে গুনে চার আঙ্গুল পরিমান ফাকা রাখার কোনো ভিত্তি নেই| আবার অনেকে বিশ্রীভাবে অনেকটা চেগিয়ে দারান এরকম করাও ঠিক নয়| পুরুষ মহিলায় এ ক্ষেত্রে কোনই পার্থক্য নাই |

কাতারে দাড়ানো:
সালাত যখন জামায়াতে আদায় করা হবে তখন কাতার সোজা করতে হবে| কাতারে কাধে কাধ এবং পায়ের গিতে গিত লাগিয়ে দাড়াতে হবে, দুই ব্যক্তির মাঝখানে ফাকা বন্ধ করতে হবে|
রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা সালাতে কাতারকে খুব সোজা কর এবং সকলের কাধ এক বরাবর করে মিলাও এবং প্রতি দুইজনের মধ্যবর্তী ফাঁক বন্ধ কর যাতে শয়তান ফাকা জায়গায় দাড়িয়ে তোমাদের সালাতে ওয়াসওয়াসা দিতে না পারে|
যে ব্যক্তি কাতারে পা মিলায় আল্লাহ তাকে কাছে নেন আর যে পা মিলায় না আল্লাহ তাকে দুরে রাখেন| আবু দাউদ ১ম খন্ড ৯৭ পৃষ্ঠা; হাকেম ১ম খন্ড ২১৩ পৃষ্ঠা| 

সহিহ বুখারীর হাদিস কাতারে পায়ে পা কাধে কাধ মেলানোর:
১ম হাদিস,
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা সালাতের ইকামত হয়ে গেলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের দিকে তার পবিত্র মুখমন্ডল ফিরিয়ে তাকালেন এবং বললেন, তোমরা তোমাদের কাতার্গুলি পরিপূর্ণ কর এবং সুদৃঢ় হও অর্থাত দালানের ইটের মত একে অপরের সাথে মিলিত হও, আমি নিশ্চই তোমাদেরকে তোমাদের পিছন থেকেও দেখে থাকি| 
২য় হাদিস,
নুমান ইবনু বাশির (রাঃ) বলেন, আমাদের (সাহাবীদের) প্রত্যেককেই দেখেছি নিজ সঙ্গীর কাধে কাধ মিলিয়ে এবং পেপর পায়ের গিট মিলিয়ে দাড়াতেন|
সহিহ বুখারী ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ১০০ |
অথচ আমাদের সমাজে কাধে কাধ, পায়ে পা লাগিয়ে কাতারে দাড়ানোকে ‘বেয়াদবি’ মনে করা হচ্ছে| সাহাবাগণ যেখানে বেয়াদবি মনে করেন নি সেখানে আমাদের হুজুররা কোন ক্ষমতাশালীর আশ্বাসে হাদিসকে অবজ্ঞা করে কাতারে ফাকা হয়ে দাড়াতে বলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়| এই ফাকা হয়ে দাড়ানোর কারণেই আমাদের মধ্যে এত এত বিভেধ আল্লাহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন|

২. তাকবীরে তাহরিমা :- সালাত শুরু হয় তাকবীরে তাহরিমা তথা দুই হাত কাধ বা কান পর্যন্ত উঠানো সাথে আল্লাহু আকবার বলা দিয়ে| সহিহ মুসলিম|
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাছুলুল্লাহ (সাঃ) যখন সালাত শুরু করতেন তখন তাকবীরে তাহরীমা অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বলতেন । অতঃপর “ইন্নী ওয়াজ্জাহতু” পড়তেন। এটি একটি সানা যা রাছুলুল্লাহ (ছাঃ) মাঝে মাঝে তাহাজ্জুত ছালাতে পড়তেন। [সহিহ বুখারী ১/১০৩ পৃঃ; আবুদাউদ ১/৫১১ পৃঃ হা/৭৬০ তাওহীদ প্রকাশনী; তিরমিযী ১/১৭৯-৮০ পৃঃ;নাসাঈ ১/১৪২ পৃঃ; মিশকাত ১/৭৭ পৃঃ ] অর্থাত ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু মূলত একটি ‘সানা’, যা তাকবীরে তাহরীমার পরে পড়া হয়|
তাকবীরে তাহরিমা তথা আল্লাহু আকবার বলার সময় দুই হাত তথা দুই হাতের আঙ্গুলের মাথা কাধ বা কানের লতি পর্যন্ত উঠাতে হয়| একে রফল ইয়াদায়ন বলা হয়| 
আমাদের সমাজে কানের লতি স্পর্শ করা বা কানের উপর পর্যন্ত হাত উঠানোর কোনো প্রমান নেই| এগুলো ভ্রান্ত কাজ|
রাসুল (সাঃ) তাকবীরে তাহরীমার সময় (বুখারী, নাসাই), কখনো তাকবিরের পরে (বুখারী, নাসাই) আবার কখনো তাকবিরের আগে দুই হাত তুলতেন (বুখারী, আবু দাউদ)|
তিনি আঙ্গুল লম্বা করে তুলতেন, তা বেশি ফাঁক করেও রাখতেন না আবার মিলিয়েও রাখতেন না (আবু দাউদ, ইবনে খুযায়মা, হাকেম)|
তিনি দুই হাত কাধ পর্যন্ত তুলতেন (বুখারী , আবু দাউদ )|
মাঝে মাঝে কানের লতি পর্যন্ত তুলতেন (মুসলিম, আবু দাউদ) | 

৩. হাত বাধা: বাম হাতের উপর ডান হাত বুকের উপর বাধতে হবে| সহিহ মুসলিম এ স্পষ্টই বুকের নিচে ও নাভির উপরে হাত বাধার সহিহ হাদিস বিদ্যমান| নাভির নিচে হাত বাধার হাদিস আবু দাউদ এ উল্লেখ রয়েছে এবং এই আবু দাউদেই নাভির নিচে হাত বাধার হাদিসকে জইফ বা দুর্বল বলা হয়েছে| এবং এই আবু দাউদেই সুস্পষ্ট হাদিস রয়েছে বুকের উপর হাত বাধার| সহিহ হাদিস বাদ দিয়ে বা সহিহ হাদিস পাওয়ার পরও দুর্বল হাদিস নিয়ে মাতামাতি করা বা দুর্বল হাদিসকে বিশুদ্ধ হাদিসের উপর প্রাধান্য দেয়া নিতান্তই ভ্রষ্টতাপূর্ণ কাজ| 
আল্লাহ বলেন ”রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” সুরা হাশর ৭ | ”যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। সুরা নিসা ৮০ |
রাসুল (সাঃ) বলেন, “তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর, যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখ”। (বুখারী ১/৮৮,মিশকাত হা/৬৩১,৬৬ পৃঃ)|
বুকের উপর হাত বাধার সহিহ হাদিস সমূহ: 
হাদিস ১ :
সহাল বিন সা’দ রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হ’ত যেন তারা সালাতের সময় ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর স্থাপন করে রাখে। আবু হাযেম বলেন যে, ছাহাবী সাহল বিন সা’দ এই আদেশটিকে রাসুল (সাঃ)-এর দিকে সম্পর্কিত বলেই জানি। বুখারী নং-৭০৪ ই.ফা. বুখারী(দিল্লী ছাপা) ১/১০২ পৃঃ, হা/৭৪০, ‘আযান’ অধ্যায়, ৮৭ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৭৯৮, ‘সালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-১০, আধুনিক প্রঃ নং-৬৯৬] উল্লেখিত হাদীসে ব্যবহৃত ‘যেরা’ শব্দের অর্থ-কনুই থেকে মধ্যমা আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত দীর্ঘ হাত। একথা স্পষ্ট যে, বাম হাতের উপর ডান হাত রাখলে তা বুকের উপরই চলে আসে। উল্লেখ্য যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন(১৯৯১), আধুনিক প্রকাশনী(১৯৮৮) প্রভৃতি বাংলাদেশের একাধিক সরকারী ও বেসরকারী প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক অনূদিত ও প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ বুখারী তে উপরোক্ত হাদীসটির অনুবাদে ‘ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপরে’ –লেখা হয়েছে। এখানে অনুবাদের মধ্যে ‘কব্জি’ লিখে নাভির নিচে হাত নামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে|
অথচ বুকের উপর হাত বাধার আরো সহিহ হাদিস রয়েছে| 
হাদিস ২:
আবু তাওবা…তাউস (রহ) থেকে বণিত । তিনি বলেন, রাসুল (সঃ) নামাজরত অবস্থায় ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে তা নিজের বুকের উপর বেঁধে রাখতেন । হাদীছটি ছহীহ। আবু দাউদ ১ম খনড হা/৭৫৯ ই.ফা.বা.প্রকাশ|
হাদিস ৩:
সাহাবী হুলব আত-ত্বাঈ (রাঃ) বলেন, আমি রাসুল (ছাঃ)-কে বাম হাতের জোড়ের (কব্জির) উপরে ডান হাতের জোড় বুকের উপরে রাখতে দেখেছি। আহমদ হা/২২৬১০, সনদ হাসান, তিরমিযী(তুহফা সহ,কায়রো-১৪০৭/১৯৮৭)হা/২৫২, ‘ছালাত’ অধ্যায়, হাদিস ৪:
ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসুল সঃ এর সাথে ছালাত আদায় করলাম। এমতাবস্থায় দেখলাম যে, তিনি বাম হাতের উপরে ডান হাত স্বীয় বুকের উপর রাখলেন। ছহীহ ইবনে খুজায়মা হা/৪৭৯,;আবু দাউদ হা/৭৫৫
উল্লেখ্য যে, বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা সম্পর্কে ১৮ জন ছাহাবী ও ২ জন তাবেঈ থেকে মোট ২০টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
চার ইমামের মধ্যে কেবল ইমাম আবুহানিফা (রহ) ব্যতীত বাকি তিন ইমামই বুকের উপর হাত বাধতেন | কিতাবুল উম লিশশাফিই | 
খুব সম্ভব ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর নিকট হাত বাধার সহিহ হাদিস পৌছেনি এবং নাভির নিচে বাধার হাদিসটি তার কাছে তখন সঠিক প্রতিয়মান হয়েছিল|

৪. চোখের দৃষ্টি: সালাতের মধ্যে চোখের দৃষ্টি সিজদার স্থানের দিকে থাকতে হবে| বায়হাকী, হাকেম, ফাতহুলবারী |
৫. সানা বা সালাত প্রারম্বের/ শুরুর দুআ: নিম্নোক্ত যে কোনো একটি পড়া যায়:

সানার জন্য ১ম দুআ: উচ্চারনঃ ”আল্লাহুম্মা বা-ঈদ বাইনী ওয়া বাইনা খাতাইয়া ইয়া কামা বা আদ’তা বাইনাল মাশরিক্বী ওয়াল মাগরিব। আল্লাহুম্মা নাক্কিনি মিনাল খাতাইয়া কামা উনাক্কাস ছাওবুল আব্‌ইয়াদু মিনাদ দানাস। আল্লাহুম্মাগসিল খাতাইয়া ইয়া বিল মা-য়ি ওয়াসছালজি ওয়াল বারাদ্‌।” বুখারী ও মুসলিম|

অর্থঃ হে আল্লাহ্‌ ! আমার ও আমার গুনাহ্‌ গুলোর মাঝে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দাও যেমন তুমি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছ। হে আল্লাহ্‌ ! আমাকে পাপ ও ভুলত্রুটি হতে এমন ভাবে পবিত্র করো যেভাবে সাদা কাপড় ময়লা হতে পরিস্কার করা হয়। হে আল্লাহ্‌ ! আমার যাবতীয় পাপসমূহ ও ত্রুটি বিচ্যুতি গুলি পানি, বরফ ও শিশির দ্বারা ধৌত করে দাও।
সানার জন্য ২য় দুআ: উচ্চারণঃ ”সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাস্‌মুকা ওয়া তা’আলা যাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা” আবূ দাঊদ ৭৭৫, ৭৭৬ ইঃফাঃ
অর্থঃ হে আল্লাহ ! তুমি পাক-পবিত্র , তোমারই জন্য সমস্ত্ প্রশংসা, তোমার নাম পবিত্র এবং বরকতময়, তোমার গৌরব অতি উচ্চ , তুমি ছাড়া অন্য কেহ উপাস্য নাই ।

৬. সালাতে আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পাঠ:

আ‘ঊযু বিল্লা-হি মিনাশ শায়ত্বা-নির রজীম।

ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১১২ পৃঃ ; নায়ল ৩/৩৬-৩৯ পৃঃ।

সানা পাঠের পর পড়তে হবে, ‘আউযুবিল্লাহীস সামিয়িল আলিমী মিনাশ শায়তানির রাজিম, মিন হামযিহি ওয়া নাফখিহি ওয়া নাফসিহি|’ আবু দাউদ ১ম খন্ড ১১৩ পৃঃ, তিরমিজি ১ম খন্ড ৩৩ পৃঃ
অর্থঃ সর্বজ্ঞাতা সর্ব শ্রোতা আল্লাহ তা’আলার নিকট বিতারিত শয়তানের কুহক, কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা হতে আশ্রয় চাচ্ছি|
অতঃপর পড়তে হবে,
’বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থঃ পরম করুনাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি| তাফসীরে ইবনে কাসীর ও দারাকুতনি |

৭. তারপর সুরা ফাতেহা পড়তে হবে :
প্রত্যেক ব্যক্তিকেই প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতেহা পরতেই হবে| এমন কি ইমামের পিছনেও সুরা ফাতেহা পরতেই হবে| কারণ সুরা ফাতেহা ব্যতীত সালাত হয় না|
১ম হাদিস
উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসুল সঃ এরশাদ করেন- ‘ ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সুরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’। বুখারী ২য় খণ্ড হা/৭২০ ইঃফাঃপ্রঃ; মুসলিম(২য়) হা/৭৭১-৭৩ বাঃ ইঃ সেন্টার প্রঃ; মুত্তাফাক আলাইহ মিশকাথা/৮২২ ‘ছলাতে কিরায়াত’ অনুচ্ছেদ; সিহা সিত্তাহ সহ প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থে উক্ত হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
২য় হাদিস: 
যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে সুরা ফাতেহা পড়বে না তার নামায হবে না (কেতাবুল কেরাত বায়হাকী ৪৭ পৃঃ; আরবী বুখারী ১ম খন্ড ১০৪ পৃঃ; মুসলিম ১৬৯ পৃঃ; আবু দাউদ ১০১ পৃঃ; নাসাঈ ১৪৬ পৃঃ; ইবনু মাযাহ ৬১ পৃঃ; মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ৯৫ পৃঃ);
৩য় হাদিস :
আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা কি ইমামের ক্বিরাআত অবস্থায় পিছনে কিছু পাঠ করে থাক? এটা করবে না। বরং কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা চুপে চুপে পাঠ করবে’।
বুখারী, জুয্উল ক্বিরাআত; ত্বাবারাণী আওসাত্ব, বায়হাক্বী, ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৮৪৪; হাদীছ ছহীহ- আরনাঊত্ব; তুহফাতুল আহওয়াযী, ‘ইমামের পিছনে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-২২৯, হা/৩১০-এর ভাষ্য (فالطريقان محفوظان) , ২/২২৮ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ২/৬৭ পৃঃ, ‘মুক্তাদীর ক্বিরাআত ও চুপ থাকা’ অনুচ্ছেদ।
৪র্থ হাদিস :
হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসুল (সঃ) এরশাদ করেছেন- ‘যে ব্যক্তি ছলাত আদায় করল,যার মধ্যে সুরায়ে ফাতিহা পাঠ করল না, তার ঐ ছলাত বিকলাঙ্গ বিকলাঙ্গ বিকলাঙ্গ, অপূর্ণাঙ্গ। হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ)-কে বলা হ’ল, আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি, তখন কিভাবে পড়ব ? তিনি বললেন, ‘তুমি ওটা ছলাতে চুপে চুপে পড়’। মুসলিম হা/৭৭৬, আবুদাউদ হা/৮২১, মিশকাত হা/৮২৩ ‘সালাতে কিরায়াত’ অনুচ্ছেদ-১২|

হে পাঠক! সহিহ হাদিস উপস্থাপন করা হলো| সহিহ হাদিসেই রয়েছে যে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সুরা ফাতেহা পড়তে হবে| হাদিসেই রয়েছে ইমামের পিছনেও চুপে চুপে মনে মনে সুরা ফাতেহা পড়তেই হবে|
উল্লেখ্য যে ইমামের কেরাতই যথেষ্ট বলতে সুরা ফাতেহার পরে যে সুরা মেলানো হয় তা বুখানো হয়েছে| কারণ সুরা ফাতেহার ব্যাপারে আলাদাভাবে বলা হয়েছে যে সুরা ফাতেহা পড়তেই হবে| এখানে কেরাত আর সুরা ফাতেহা এক বিষয় নয়|
সম্মানিত পাঠক স্মরণ করুন,
আল্লাহ বলেন ”রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর।” সুরা হাশর ৭ | ”যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। সুরা নিসা ৮০ |
রাসুল (সাঃ) বলেন, “তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর, যে ভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখ”। (বুখারী ১/৮৮,মিশকাত হা/৬৩১,৬৬ পৃঃ)|
অতএব রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশ উপেক্ষা করে যারা কতিপয় হুজুরের নির্দেশে সুরা ফাতেহা পাঠ থেকে বিরত থাকছেন সহিহ হাদিস অনুসারে তাদের সালাত অসম্পূর্ণ, অপুর্নাঙ্গ ও বিকলাঙ্গ|

নিছে স্কান কপি দেওয়া হলো

দেখুন পার্ট ২
Like · Comment · 

No comments:

Post a Comment